স্বপ্ন বা আরবীতে যাকে বলা হয় خواب আমরা সচরাচর ঘুমাইলে আমাদের ঘুমের মধ্যে যে আচরণ বা কর্মকান্ড গুলো আমরা দেখে থাকি তাকেই আমরা সাধারণত স্বপ্ন বা خواب (খোয়াব) বলে থাকি স্বপ্নের আরেকটি আরবি শব্দ আছে যেটাকে الحام বলা হয়। প্রত্যেকটি স্বপ্নও তার কিছু নির্দিষ্ট কারণ বহন করে আমরা বুঝি আর না বুঝি। তবে যে সমস্ত স্বপ্নের কথা কাউকে বলা যাবে না সেগুলো আজ আমি আপনাদের জ্ঞানের সমৃদ্ধির জন্য আলোচনার চেষ্টা করব। পবিত্র কোরআনের মধ্যে সূরা ইউসুফ এর তিন নাম্বার আয়াতে আল্লাহতালা বলেন
نَحْنُ نَقُصُّ عَلَيْكَ أَحْسَنَ ٱلْقَصَصِ بِمَآ أَوْحَيْنَآ إِلَيْكَ هَـٰذَا ٱلْقُرْءَانَ وَإِن كُنتَ مِن قَبْلِهِۦ لَمِنَ ٱلْغَـٰفِلِينَ ٣
হে নবী আমি কোরআন থেকে ওহীর মাধ্যমে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠতম একটি গল্প শোনাচ্ছি।
সূরা ইউসুফ হচ্ছে এই পৃথিবীর সবচেয়ে শ্রেষ্ঠতম গল্প যত গল্প আছে যত সাহিত্য আছে সকল গল্পের থেকে শ্রেষ্ঠ সকল সাহিত্যের থেকে শ্রেষ্ঠ এমন কি স্বয়ং পবিত্র কোরআনের অন্য সকল গল্প থেকে কিচ্ছা থেকে শ্রেষ্ঠ হচ্ছে সূরা ইউসুফ এর কিচ্ছা বা গল্প। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন أَحْسَنَ ٱلْقَصَصِ অর্থাৎ সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ গল্প। আমাদের সমাজে এক শ্রেণীর মানুষ আছে কেচ্ছা শব্দটা শুনলেই কেমন যেন একটা তাদের মধ্যে অন্যরকম আচরণ অনুভব করা যায় তারা এটাকে অনেক নিম্ন ভাবে দেখেন কিন্তু আসলে বিষয়টি হলো কেচ্ছা বা গল্প যদি শিক্ষনীয় হয় আর যদি সেটা পবিত্র কোরআন থেকে হয় তাহলে এটা অনেক উত্তম। আচ্ছা এখন আমাদের মধ্যে কারো এটা মনে হতে পারে যে কোরআনের মত একটি শ্রেষ্ঠ কিতাবের মধ্যে আল্লাহ তা’আলা গল্প বা কেচ্ছা কেন বর্ণনা করলেন এবং এটার জন্য সুপারিশ পেশ করলেন যে এটাই সবথেকে শ্রেষ্ঠ গল্প বা কেচ্ছা এর কারণ কি…? এর কারণ হলো মানুষ গল্পের প্রতি বেশি আকৃষ্ট হয় এবং এ গল্পের মাধ্যমে যদি শিক্ষা নেওয়া যায় নিজের জীবনকে পরিবর্তন করা যায় তাহলে এর মধ্যে খারাপ কি।
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন وَلَقَدْ أَرْسَلْنَا رُسُلًۭا مِّن قَبْلِكَ مِنْهُم مَّن قَصَصْنَا عَلَيْكَ وَمِنْهُم مَّن لَّمْ نَقْصُصْ عَلَيْكَ ۗ অনেক নবীর ঘটনা হে নবী আপনাকে আমি শুনিয়েছি আবার অনেক নবীর ঘটনা আমি শুনাই নি فقصص القصص لعلهم يتفكرون যেগুলো আমি শুনেছি তা আপনি আপনার উম্মতদেরকে শোনান। আল্লাহ তাআলা এই কারণেই গল্প বা কেচ্ছা আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন যাতে করে এটা থেকে আমরা শিক্ষা নিতে পারি। সূরা ইউসুফ এর মধ্যে আমরা সর্বপ্রথম যে শিক্ষাটি নিতে পারি সেটা হল স্বপ্নের কথা যা মানুষ ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে দেখে তা কারো সাথে শেয়ার করতে নেই। ইউসুফ আলাইহিস সালাম বাল্যকালে যে স্বপ্নটি দেখেছিলেন সেটি হল ১১টি তারা চাঁদ সূর্য তাকে সিজদা করছে। এবং এরপরে তিনি এ সমস্ত ঘটনা পিতা ইয়াকুব আলাইহিস সালাম এর সাথে শেয়ার করেন। তখন ইয়াকুব আলাইহিস সালাম বলেন لَا تَقْصُصْ رُءْيَاكَ عَلَىٰٓ إِخْوَتِكَ فَيَكِيدُوا۟ لَكَ كَيْدًا ۖ তুমি একথা আমাকে বলেছ কিন্তু তোমার ভাইদেরকে বলো না অন্যথায় তারা তোমার প্রতি ঈর্ষান্বিত হবে।
এখানে হযরত ইয়াকুব আলাইহিস সালাম তার পুত্র ইউসুফকে আর অন্য ভাইদের কাছে এ বিষয়টি গোপন করতে বলার কারণ হলো ঈর্ষা মানুষের স্বভাবগত আচরণ এটা পূর্ব থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত প্রায় সকলের মধ্যেই বিদ্যমান শুধুমাত্র এতোটুকু পার্থক্য হতে পারে যে কারো মধ্যে ঈর্ষা কম রয়েছে এবং কারো মধ্যে ঈর্ষা বেশি রয়েছে। এছাড়াও স্বপ্ন মানুষের জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ জিনিস কারণ আল্লাহ তায়ালা অনেক সময় মুমিনদেরকে স্বপ্নের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দিয়ে থাকেন। যা মুমিনের জীবনে অনেক বড় একটি ভূমিকা পালন করে। স্বপ্নের কথা ওই সকল ব্যক্তিদের কাছে বলা যায় যারা এ বিষয়ে বিজ্ঞ এবং শুভাকাঙ্ক্ষী কারণ এ সকল বিষয় সকলের কাছে প্রকাশ করা যায় না কারণ আল্লাহ তাআলা স্বপ্নের মাধ্যমে মুমিনকে গোপনে এই সংবাদগুলি দিয়ে থাকেন।
সত্য স্বপ্নের আলামত কি কি
আমরা যখন স্বপ্ন দেখি এরপরে সর্বপ্রথম আমাদের মনে যে কথাটি আসে সেটা হল আমি যে স্বপ্নটি দেখলাম সেটা সত্য অথবা অসত্য এটা কিভাবে বুঝব বা এই স্বপ্নের নেই আমার সাথে ঘটবে কিনা..? কিছু কিছু আলামত কিছু কিছু নিদর্শন রয়েছে যেগুলোর মাধ্যমে আমরা খুব সহজেই বুঝতে পারব যে আমি যেই স্বপ্নটা দেখেছি সেটা সত্য কিনা। সুনানে আবু দাউদ এর এক বর্ণনায় এসেছে হযরত রাসুল সাঃ এরশাদ করেছেন أَصْدَقُ النَّاسِ رُؤْيَا أَصْدَقُهُمْ حَدِيثًا যে ব্যক্তি সত্য কথা বলে বেশি তার স্বপ্ন সত্য হয় বেশি এই হাদিস থেকে আমরা বুঝতে পারি যে কেউ যদি সত্য কথা বলে তাহলে তার স্বপ্নগুলো সত্য হয়। সত্য স্বপ্ন বা অর্থবহ স্বপ্ন চেনা প্রথম আলামত হলো:- স্বপ্ন দেখার মাধ্যমে মনে প্রশান্তি লাভ করবে ভালোলাগা অনুভব করবে। যদি এইরূপ কারো সাথে হয় তাহলে তার স্বপ্নটা সত্যি বা অর্থবহ এমনটাই সাধারণত হওয়ার কথা। সত্য স্বপ্ন চেনার দ্বিতীয় আলামতটি হল সত্য স্বপ্নগুলো অত্যন্ত কম সময়ের হয়ে থাকে, খুবই কম সময়ের এবং স্পষ্ট কিলিয়ার আমাদের মধ্যে অনেকে এমন আছে যে রাত্রিবেলা অনেক সময় নিয়ে স্বপ্ন দেখেন এই জাতীয় স্বপ্নগুলো সাধারণত কোন অর্থ হয় না।
অর্থবহ স্বপ্ন চেনার দ্বিতীয় নাম্বার আলামত হলো একই স্বপ্ন বারবার দেখা, কেউ যদি একই স্বপ্ন বারবার দেখে তাহলে বুঝতে হবে এটা অর্থবহ স্বপ্ন যার মাধ্যমে আল্লাহ তা’আলা তাকে কোন দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন। এখানে আরেকটি কথা একই স্বপ্ন যদি কেউ একাকী বারবার দেখে সেটা যেমন কার্যকর ঠিক তেমনিভাবে একই স্বপ্ন যদি একের অধিক মানুষ একইভাবে বারবার দেখে তাহলেও সেটা কার্যকর। এক্ষেত্রে সহি বুখারীর একটি হাদিস রয়েছে যেটাতে বলা হয়েছে পবিত্র রমজান মাসে সাহাবারা একটি স্বপ্ন দেখলেন যে তাদেরকে বলা হচ্ছে রমাদানের এই শেষ দশকে শেষ-৭ দিনের যেকোনো একদিন কদর হয়ে যেতে পারে। পরবর্তীতে ওই সকল সাহাবা হযরত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে এ বিষয়টি বর্ণনা করলেন তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন ارى رؤياكم قد تواطئ اطفي السبيعي اخر আমি দেখতে পেলাম যে তোমাদের এ স্বপ্নটি রমজানের সাত দিনের বিষয়ে ঐক্যমত্ত হয়েছে তোমরা সকলেই একই স্বপ্ন দেখেছো তাই তোমরা রমজানের শেষ দশকের শেষ সাত দিনে কদর তালাশ কর এর মধ্যেই কদর হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। সহি বুখারীর এই হাদীস থেকে আমরা বুঝতে পারলাম যে একই স্বপ্ন যদি একের অধিক মানুষ দেখে তাহলে সেটাও অর্থবহ স্বপ্ন।
পাশাপাশি আমরা আযানের হাদিসটি উল্লেখ করতে পারি অর্থাৎ নামাজের আগে যে আযান আমরা শুনে থাকি পূর্বে এই আজান ছিল না তখন সাহাবারা আল্লাহর রাসূল এর সাথে আলোচনা করছিলেন যে কিভাবে আজান দেওয়া যায় অর্থাৎ কিভাবে মানুষকে নামাজের জন্য আহবান করা যায় এক সাহাবা মত দিলেন যে আমরা আগুন জ্বালিয়ে দেব আগুনের ধোঁয়া দেখে মানুষজন বুঝতে পারবে যে নামাজের সময় হয়েছে এবং তারা নামাজ আদায়ের জন্য আসবে আরেকজন মত দিলেন যে না আগুন জ্বালানো এটা নিরাপদ নয় আমরা খ্রিস্টানদের মতো বেল বাজিয়ে দেব এভাবে একেক জন একেক পরামর্শ দিতে লাগলো তখন আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম এ বিষয়ে কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারলেন না পরের দিন একজন সাহাবা চমৎকার একটি স্বপ্ন দেখলেন।
তার নাম ছিল আব্দুল্লাহ ইবনে জায়েদ ইবনে আব্দে রাব্বি তিনি স্বপ্নে দেখলেন একজন লোক যিনি খুব সম্ভবত ফেরেশতা হবেন তার শরীরে দুইটা সবুজ রঙের জামা এবং তার হাতে বেল বা ঘন্টা তখন তিনি উক্ত ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসা করলেন আপনি কি ঘণ্টা বিক্রি করেন তখন স্বপ্নের মধ্যে ঐ ব্যক্তি বললেন ঘন্টা দিয়ে তুমি কি করবে সাহাবী বললেন ঘন্টা দিয়ে আমরা নামাজের জন্য আহ্বান করব তখন স্বপ্নের মধ্যে সেই সবুজ কাপড় পরিহিত লোকটি বলল ঘন্টার চেয়েও যদি উত্তম একটি পন্থা তোমাকে আমি জানাই সেটা কি তুমি শুনবে সাহাবী বললেন হ্যাঁ শুনবো তখন তিনি বললেন ঘন্টা না বাজিয়ে তোমরা উঁচু একটি জায়গায় দাঁড়িয়ে আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার, আশহাদু আল্লাহ ইলাহা ইল্লাল্লাহ,আশহাদু আন্না মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ, এভাবে আযানের বাক্য গুলো বলতে লাগলেন এবং তাকে বললেন এই বাক্যগুলো বলে নামাজের জন্য ঘোষণা প্রদান করতে এমত অবস্থায় ওই ব্যক্তির ঘুম ভেঙে গেল তিনি সকালবেলা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে এসে পূর্ণ ঘটনার বর্ণনা দিলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই স্বপ্নের কথা শুনে ঐ সাহাবীকে বললেন তুমি ঠিকই দেখেছো যেহেতু বেলালের কন্ঠ অনেক উঁচু আওয়াজে তাই বেলালকে ডাকো আর ঘন্টাও বাজানোর দরকার নেই আগুন ও জ্বালানোর দরকার নেই তুমি বেলালকে এই বাক্যগুলো মুখস্থ করিয়ে দাও বেলাল মসজিদে নববী এর পাশে দাঁড়িয়ে আওয়াজ করে আজান দেবে ঘোষণা করবে এভাবে আজান এর প্রচলন শুরু হল।
এই বাক্যগুলো শুনে সাইয়্যেদেনা ওমর ফারুক রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু দৌড়াতে দৌড়াতে হযরত সাঃ এর কাছে আসলেন এসে বললেন ইয়া রাসুল আল্লাহ বেলাল এই বাক্যগুলো কোথায় থেকে শিখেছে গতরাতে তো আমি স্বপ্নে দেখেছি আমাকে একজন লোক বলেছে যে তোমরা এই বাক্য গুলোকে ব্যবহার করে নামাজের জন্য ঘোষণা প্রদান কর। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শুনে অবাক হলেন অর্থাৎ ওই সাহাবী যেই একই স্বপ্ন দেখেছেন ঠিক সেই রকমই হযরত ওমর ফারুক রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুও দেখেছেন। অর্থাৎ একটি স্বপ্ন যদি একাধিক লোক দেখে থাকে তাহলে সেটা যেমন অর্থবহ ঠিক তেমনি ভাবে কেউ একাই যদি এরকম কোন স্বপ্ন বারবার বারবার দেখে তাহলেও সেটা অর্থবহ। অর্থবহ স্বপ্ন দেখার চার নম্বর আলামত হলো অর্থবহ স্বপ্নগুলো সাধারণত শেষ রাতের দিকেই বেশিরভাগ হয়ে থাকে। এছাড়াও কিয়ামতের আগ মুহূর্তে যখন মুসলমানরা অত্যন্ত বিপদের মধ্যে থাকবে তখন তারা রাত্রে যে স্বপ্নগুলো দেখবে তার অধিকাংশই সত্য স্বপ্ন।